BD Yellow Pages

ভাসানী নভো থিয়েটার


আকাশ নিয়ে মানুষের ভাবনা সেই প্রাচীনকাল থেকে। তখন মানুষ খালি চোখে আকাশ দেখতো। আকাশের ভেতর তারা খুঁজে পেয়েছিল অনেক পৌরানিক চরিত্র। মহাকাশের মোটামুটি গ্রহনযোগ্য একটি কাঠামো আমরা পাই টলেমির কাছ থেকে। সেই কাঠামোর মাঝখানে ছিল নিশ্চল পৃথিবী, তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে বাকি সব গ্রহ নক্ষত্র। বহু বছর পর এই ধারণা বদলে ড্যাং নিকোলাস কোপার্নিকাস নামে এক জ্যোতির্বিদ। তার মহাবিশ্বের কেন্দ্রস্থলে আমরা দেখি সূর্যকে। এই ধারণা প্রচলিত বিশ্বাসের পরিপন্থি ছিল। এজন্য তাকে অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। আজ আমরা জানি, পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহ। বুধ বা শুক্রের মতোই একটি গ্রহ। এই গ্রহগুলো ঘুরছে সূর্যকে কেন্দ্র করে। সূর্যের এ পরিবারকে আমরা বলি সৌরজগৎ। মহাবিশ্বে এরকম সৌরজগৎ মাত্র একটিই নয়। অনেক, কোটি কোটি। এসব সত্য আবিস্কার করতে গিয়ে সর্বস্ব উৎসর্গ করেছেন অনুসন্ধানী মানুষরা যুগ যুগ ধরে। হাজার বছর ধরে জমানো এ সত্যের কতটা আমরা জানি? মহাকাশ সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই ধারণা এখনও কুসংস্কারাচ্ছন্ন, ধোঁয়াটে। সম্প্রতি ঢাকাতে মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষকে ভালোভাবে জানাতে একটি প্ল্যানেটারিয়াম স্থাপিত হয়েছে। এ প্লানেটারিয়ামের নাম নভো থিয়েটার। ঢাকা বিজয় সরণিতে সামরিক জাদুঘরের পাশেই তৈরি হয়েছে এই নভো থিয়েটার। শো শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা আগে থেকে টিকিট পাওয়া যায় টিকিট কাউন্টারে। টিকিটের দাম তলনামূলক অনেক কম। একজন একসঙ্গে সর্বোচ্চ তিনটা টিকিট নিতে পারবেন। প্রতিদিন শ হবে চারটা। সকাল ১১টায়, দুপুর ১টায়, বিকাল ৩টিয় ও ৫টায়। শুক্রবার রুটিন খানিকটা বদলায়। সকাল ১০টায় শো হবে একটা। এরপর বিকাল ৩টায়, ৫টায় ও ৭টায়। বুধবার বন্ধ থাকে। একশো তেত্রিশ কোটি টাকা বাজেটে তৈরি করা ভাসানী নভো থেয়েটারের মোট আয়তন ৫.৪ একর। সামনে ছোট্ট লন ঘেরা। ইট আর কংক্রিট দিয়ে সাজানো হয়েছে নভো থিয়েটারের চারপাশ। ঢোকার মুখেই রয়েছে দুটি সিম্বল। একটি ডানা মেলা বকের, অন্যটি প্ল্যানেটারিয়ামের গঠনশৈলী। মাঝখানে মেটালিক নীল রঙের ডোম। বাইরে থেকে গোল গম্বুজের মত দেখায়। নভো থিয়েটারের ডিজাইন করেছেন স্থপতি আলী ইমাম। পুরো প্লানেটারিয়াম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে। টিকিট নিয়ে ভিতরে ঢুকলে চোখে পড়বে এক্সিবিশন হল। মোট চারটি লেভেলে সাজানো হয়েছে হলটি। হল অব দি ফেম নামে একটি আর্ট গ্যালারি আছে বা দিকে। গ্যালারিতে রয়েছে বিশ্ব নন্দিত বিজ্ঞানীদের আবক্ষ মূর্তি। এক্সিবিশন হলে রয়েছে একটি ত্রিমাত্রিক মদেল সোলার সিস্টেম, সূর্য, চাঁদ আর পৃথিবীর একটি মডেল, স্বচ্ছ গোলক, সৌরজগত, তারাদের আকার, মহাকাশে তারাদের অবস্থান জানতে স্টার ফাইন্ডার আর আছে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের অনেকগুলো পোস্টার। প্লানেটারিয়ামের ঠিক মাঝখানটাতে তৈরি হয়েছে থিয়েটার হল। এটি মূলত একটি এলুমিনিয়ামে বানানো ডোম। আমেরিকান একটি টিম এটা ইনস্টল করে দিয়ে গেছে। ডোমটির উচ্চতা পাঁচতলা বাড়ির সমান। ডোমের ভিতরে ঢুকলে আপনার মনে হবে আপনি ঢুকে পড়েছেন আরেকটি ছোট্ট পৃথিবীতে। কারণ এটি বানানো হয়েছে একটি ভূগোলকের আদলে, যা সাম্নের দিকে হেলে আছে। ডোমের ঠিক অর্ধেক জুড়ে আছে ২৩ মিটার ব্যাসের সুবিশাল থ্রি ডাইমেনশনাল পর্দা। পর্দার নিচে নীল রঙের চেয়ার দিয়ে পুরো অডিয়েন্স সাজানো। চেয়ারগুলো পেছনে হেলানো যায়। এতে করে পুরো পর্দাটাই আপনি ভালো করে দেখতে পাবেন। এখাঙ্কার মোট আসন সংখ্যা ২৭৫। বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এ থিয়েটারে। পর্দায় ছবি ফুটিয়ে তোলার জন্য আছে ৩২টি অতি শক্তিশালী প্রজেক্টর। ছবিতে স্পেশাল ইফেক্টের ব্যবহার রয়েছে। জীবন্ত শব্দের জন্য আছে ১০ হাজার ওয়াটের সারাউন্ড সাউন্ড সিস্টেম। পর্দায় একসঙ্গে দেখা যাবে ২৫ হাজারের বেশি নক্ষত্র। ছবি দেখার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে এস্ট্রোভিশন ফিল্ম। মোট দুটো শো দেখানো হবে। এর মধ্যে প্রথমটি দেখানো হবে একটি প্লানেটারিয়াম শো। এটার দৈর্ঘ্য ৩৭ মিনিট ৩৮ সেকেন্ড। শো শুরু হওয়ার আগে সব আলো নিভে যাবে। আকাশের মত পর্দায় ভেসে উঠবে গোধূলীবেলার ঢাকা শহর। যেখানে সূর্য নেমে যাচ্ছে ক্রমশ, হারিয়ে যাচ্ছে আলো। কিছুক্ষন পর আপনি মাথার উপরে দেখবেন মেঘমুক্ত নির্মল কৃষ্ণপক্ষ রাতের নক্ষত্র খচিত আকাশ। এ আকাশ দেখে আপনার টাশকি লেগে যেতে পারে। আপনি সম্ভবত ভুলে যাবেন যে আপনি বসে আছেন একটি ডোমের ভেতর। আপনি চিরচেনা আকাশকে কিছুতেই পর্দার এ আকাশ থেকে আলাদা করতে পারবেন না। আপনাকে বের হতে হবে একটি ট্যুরে যেখানে ছুটে যাবেন মহাকাশ যানে করে সোলার সিস্টেমের দিকে। আপনি ক্রমশ জানবেন আকাশে কোন তারা কোথায় থাকে, জানবেন রাশিচক্রের বারোটি ছায়াপথের অবস্থান। নক্ষত্রগুলোর নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা গ্রিক মিথলজিগুলোও জানা যাবে। দেখানো হবে গ্যালাক্সিগুলো, আমাদের ছায়াপথ, এন্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জ। একে একে আরো জানা যাবে মিল্কিওয়ে, তারাদের জন্মমৃত্যু, বিগ ব্যাং, সুপার নোভা, ব্লাক হোলের কথা। সৌরজগতের একটি বেশ গোছানো পরিচয়ও পাবেন আপনি। একজন ভাষ্যকার বাংলায় আপনাকে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করবেন। দেখতে দেখতে আপনার মনে হবে থিয়েটার হল্টি আর স্থির হয়ে নেই এক জায়গায়। এটা বদলে গেছে একটি মহাকাশযানে, যা আকাশের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত ছুটে বেড়াচ্ছে আপনাকে নিয়ে। আপনি আকাশের ভেতর দিয়ে তারাদের মধ্যে উড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা পাবেন। মাঝখানে ১০ মিনিটের বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় শো শুরু হবে। এটা মূলতঃ একটি ওয়াইল্ড লাইফ ডকুমেন্টারি, নাম Africa: The Serengeti. এটাদৈর্ঘ্যে ৪০ মিনিট। এখানে দেখানো হয়েছে জলের সন্ধানে ছুটে যাচ্ছে একদল প্রাণী। খুবই আকর্ষণীয় কিছু প্রাণীর জীবনযাত্রা জানা যাবে এই শো থেকে। আপনি দেখবেন শ্বাসরুদ্ধকর শিকারের দৃশ্য, তাড়া খাওয়া হরিণের পিছনে বাঘ পরিচয় করিয়ে দিবে আদিম সৌন্দর্যের সঙ্গে। এছাড়াও দেখানো হবে মাসাই নামে একটি ট্রাইবের জীবনপ্রণালী। ভাসানী নভো থিয়েটার এদেশের মানুষের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। এত আধুনিক কোন হল এর আগে বাংলাদেশে নির্মিত হয়নি। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এরকম প্লানেটারিয়াম রয়েছে। আমাদের পাশের দেশ ভারতে আছে মোট ১৯টি। এর মধ্যে ৪টি আছে পশ্চিমবঙ্গে। পাকিস্তানেও তিনটি প্লানেটারিয়াম আছে। কোন এক দিনে পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলে আসুন না এখানে।